এম এ খালেক
এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছিল। পরীক্ষার মাত্র কয়েকদিন আগে এক বন্ধুর জন্ম দিন ছিল। সেই জন্ম দিন উপলক্ষে মাঝ রাতে হোস্টেল প্রাঙ্গনে বন্ধুরা জন্ম দিনের উৎসবে মিলিত হয়েছিল। আনন্দের মাত্রাটা একটু বেশিই ছিল। নৃত্যের তালে তালে এক আর এক বন্ধুর গায়ে কেক,ডিম ময়দা ইত্যাদি ছুড়ে মারছিল। ছাত্রদের হৈচৈ ভালো লাগেনি কলেজ ছাত্রাবাসের আবাসিক শিক্ষকের(মনিরুল ইসলাম)। তাই তিনি উত্তেজিত অবস্থায় আনন্দরত ছাত্রদের গালাগাল শুরু করেন। ছাত্ররা ভয়ে যার যার কক্ষে চলে যায়। আবাসিক শিক্ষক ছাত্রদের বাইরে আসতে বলেন। ছাত্ররা বাইরে এলে শিক্ষক মনিরুল ইসলাম তাদের গালাগাল দেন। এ সময় ছাত্ররা কিছু বলতে গেলে তিনি আরো উত্তেজিত হয়ে উঠেন। এক পর্যায়ে শিক্ষক মনিরুল ইসলাম পর্দা টানানোর অ্যালুমিনিয়ামের পাইপ দিয়ে একজন ছাত্রকে পেটাতে শুরু করেন। এতে ছাত্রটি মারাত্মকভাবে অহত হয়। তার হাত দিয়ে রক্ত বেরুতে শুরু করে। একজন ছাত্র এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন,রক্ত পড়ছে পড়ুক। একজন শিক্ষক তার সন্তানতুল্য ছাত্রের প্রতি এমন নির্দয় উক্তি কিভাবে করতে পারলেন? পরবর্তীতে ছাত্রাবাসের তত্বাবধায়কের নির্দেশে ছাত্ররা যার যার কক্ষে প্রবেশ করে। একজন শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রকে এই নির্মম নির্যাতনের ঘটনাটি ফেইস বুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়। ছাত্র নির্যাতনের এই অনাকাঙ্খিত ঘটনাটি ঘটে গত ২৭ মার্চ রাজধানীর ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজ ছাত্রাবাসে। ঢাকার বাইরে কোনো মফ:স্বল শহরে ছাত্র নির্যাতনের এমন নির্মম ঘটনা ঘটলে হয়তো অনেকেই অবাক হতেন না। কিন্তু খোদ রাজধানীর একটি কলেজ ছাত্রাবাসে এমন ঘটনা কিভাবে ঘটলো? শিক্ষকের নিকট একজন ছাত্র হচ্ছে আপন সন্তানতুল্য। মূলত এ কারণেই শিক্ষককে বলা হয় পিতৃতুল্য অভিভাবক। পিতা সন্তানকে জন্ম দেন। কিন্তু সেই সন্তানকে ভবিষ্যতের জন্য সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন একজন শিক্ষক। শিক্ষকের উপযুক্ত শিক্ষা ব্যতীত একজন ছাত্র কখনোই নিজেকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে পারে না। যে শিক্ষক তার সন্তানতুল্য একজন ছাত্রকে মেরে রক্তাক্ত করলেন তিনি কি সত্যি শিক্ষক সমাজের উপযুক্ত? ইতোমধ্যেই কলেজ কর্তৃপক্ষ ঘটনার তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছেন। তদন্ত কমিটি কি রিপোর্ট দেবে বা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কোনো শাস্তি হবে কিনা সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে একজন শিক্ষক,ছাত্রদের নিকট যার স্থান পিতার পরেই তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে তার মান সম্মান কোথায় রইলো? ছাত্ররা হয়তো আবেগের বশবর্তী হয়ে কিছুটা বাড়াবাড়ি করেই ফেলেছে কিন্তু তাই বলে কি তাকে পিটিয়ে শেখাতে হবে? শিক্ষকের এক ধমকই কি ছাত্রদের শান্ত করতে যথেষ্ট ছিল না? শিক্ষক যদি মুখের কথায় তার ছাত্রদের শান্ত করতে না পারেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের ব্যর্থতা। কারণ তিনি ছাত্রদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারেন নি। তাদের আদব-কায়দা শিক্ষা দিতে পারেন নি। এই ব্যর্থতার দায় তিনি কিভাবে এড়াবেন?
শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রদের শাসন করার ঘটনা নতুন কিছু নয়। এমন কি ছাত্রদের পেটানোর ঘটনাও আগে অহরহই ঘটতো। তবে ছাত্র পেটানোর ঘটনা গ্রামের স্কুলেই বেশি ঘটতো। সাধারণত শহরের শিক্ষকগণ প্রচলিত আইন-কানুন সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞাত থাকেন বলে তারা ছাত্র পেটানোর মতো ঘৃণ্য কাজ করেন না। একজন ছাত্র বা ছাত্রী আনন্দের সঙ্গে লেখাপড়া করবে এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষক ছাত্রদের শাসন করতে পারেন তাতে কোনো নিষেধ নেই। কিন্তু সেই শাসন কখনোই শারিরিক নির্যাতনের মাধ্যমে হতে পারে না। কয়েক দশক আগেও আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলোতে প্রায়শই ছাত্রদের শারিরিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটতো। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হলে এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়। বর্তমান সরকার সার্বজনিন শিক্ষা বিস্তারের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে কিছু পদক্ষেপ বা কার্যক্রম যুগান্তকারি। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে শতভাগ ছেলে-মেয়েকে বিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। নির্দিষ্ট শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ সৃষ্টি করা। সরকারের এসব বহুমুখি কার্যক্রমের ফলে বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির হার অনেক বেড়েছে। একই সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-ছাত্রীদের যাতে শারিরিক নির্যাতন করা না হয় সে জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র(আসক) এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট(ব্লাষ্ট) এর দায়েরকৃত একটি রিটের প্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ একটি যুগান্তকারি রায় প্রদান করেন। এই রায়ের শিক্ষাঙ্গরে ছাত্র-ছাত্রীদের শারিরিক এবং মানসিক নির্যাতন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১১ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রদত্ত উক্ত রায়ে বলা হয়েছে,‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারিরিক শাস্তি শিশুদের জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করে এবং তা নিষ্ঠুর,অমানবিক,অপমানকর আচরণ এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭,৩১,৩২,৩৫(৫) অনুচ্ছেদের পরিপন্থি।’ এই রায়ের প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারিরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের শারিরিক ও মানসিক শাস্তি রহিতকরা সংক্রান্ত নীতিমালা,২০১১’জারি করে। নির্দেশনায় শারিরিক শাস্তি বলতে: (ক) হাত-পা বা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করা, (খ) তাদের দিকে চক,ডাস্টার বা অন্য কিছু ছুঁড়ে মারা, (গ) ছাত্র-ছাত্রীদের শরীরে আঁচড় দেয়া বা চিমটি কাটা,(ঘ) তাদের চুল ধরে টানা,(ঙ) কান ধরে উঠবস করানো,(চ) চেয়ার টেবিল বা অন্য কিছুর নিচে ছাত্র-ছাত্রীদের মাথা ঢুকিয়ে রাখা বা সূর্যের দিকে তাকিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা ইত্যাদিকে বুঝাবে। মানসিক শাস্তি বলতে ক্লাসে কোনো ছাত্র বা ছাত্রীকে এমন কোনো মন্তব্য করা যাবে না যাতে সে কস্ট পেতে পারে। মা-বাবার বংশ পরিচয় বা ধর্ম নিয়ে এমন কোনো মন্তব্য করা যাবে না সংশ্লিষ্ট ছাত্র বা ছাত্রী লজ্জিত হতে পারে বা কস্ট পেতে পারে।
যদি কোনো শিক্ষক এই নির্দেশনা লঙ্ঘন করে ক্লাসে কোনো ছাত্র বা ছাত্রীকে শারিরিক বা মানসিক শাস্তি প্রদান করেন তাহলে তা সরকার কর্মচারি আচরণ বিধির লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে। এ জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। সেই বিধান মোতাবেক সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের শাস্তি হতে পারে। শিক্ষকদের অনেকেই আইনের এই বিধানগুলো জানেন না বা জানলেও এ ব্যাপারে সচেতন নন। তাই তারা প্রায়শই আইনের বিধান লঙ্ঘন করে ছাত্র-ছাত্রীদের শারিরিক এবং মানসিক শাস্তি প্রদান করে থাকেন। ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজ ছাত্রাবাসের যে ছাত্রটিকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে সে হয়তো ইতোমধ্যেই সুস্থ্য হয়ে উঠেছে। এইচএসসি পরীক্ষাতেও হয়তো অংশ নেবে। কিন্তু সে এই ঘটনায় যে মানসিক কস্ট পেয়েছে তার কি কোনো উপশম হবে? আগামীতেও এই মানসিক ক্ষত তাকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করবে। শাসনের নামে এ ভাবে কারো মনোজগতে ভীতি এবং অশ্রদ্ধা সৃষ্টি করা কি কোনোভাবেই ঠিক হলো?